গতরাতে
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সিএনএন এর ইন্টারভিউটি দেখার পর অনেকেই আজ ইতালি'র
জগদ্বিখ্যাত সাংবাদিক অরিয়ানা ফালাসি'র কথা মনে করেছেন।
ইত্তেফাক-এর সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু-কে যারা চিনেন,তারা জানেন
যে,তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াঁ'র এই গুনধর পুত্র'টির মাঝে কিছুটা হলেও
পিতার মতো গ্লোবাল পলিটিক্স বুঝার এক অনবদ্য জ্ঞান আছে। হোয়াটএভার,
সেই আনোয়ার হোসেন মঞ্জু'র অনুবাদ করা অরিয়ানা ফালাসি'র,শেখ মুজিবের নেয়া সাক্ষাতকার টি নীচে হুবুহু তুলে দিলাম।
হিস্টরি কিভাবে রিপিট হয় নিজের চোখেই দেখুন -
ইতালির প্রখ্যাত সাংবাদিক ওরিয়ানা ফালাচীর সাথে শেখ মুজিবের সাক্ষাৎকারঃ-
(ইন্টারভিউ উইথ হিস্টরী- ওরিয়ানী ফালাসী; অনুবাদ- আনোয়ার হোসেন মঞ্জু; ইত্তেফাক)
ইতালির প্রখ্যাত সাংবাদিক ওরিয়ানা ফালাচীর সাথে শেখ মুজিবের সাক্ষাৎকারটি
ছিল ঐতিহাসিক। শেখ মুজিবের চরিত্র,আত্ম-অহংকার,যোগ্যতা ও মানবতার মান
বুঝবার জন্য আর কোন গবেষণার প্রয়োজন নেই,সে জন্য এই একটি মাত্রসাক্ষাৎকারই
যথেষ্ট।এখানে সে বিখ্যাত সাক্ষাতাকারের কিছু অংশ তুলে ধরা হলঃ
রোববার
সন্ধাঃ আমি কোলকাতা হয়ে ঢাকার পথে যাত্রা করেছি। সত্যি বলতে কি,১৮ই
ডিসেম্বর ১৯৭১; মুক্তিবাহিনী তাদের বেয়োনেট দিয়ে যে যজ্ঞ চালিয়েছে তা
প্রত্যক্ষ করার পর এ পৃথিবীতে আমার অন্তিম ইচ্ছা ছিল যে, এই ঘৃন্য নগরীতে
আমি আর পা রাখবো না- এ রকম সিদ্ধান্ত আমি নিয়েই ফেলেছিলাম। কিন্তু আমার
সম্পাদকের ইচ্ছা যে, আমি মুজিবের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। (এখানে ওরিয়ানা
ফালাচী সেই ১৮ই ডিসেম্বরের বীভৎস বর্বর ঘটনাকে ইঙ্গিত করছেন।) ঢাকা
স্টেডিয়াম কাদের সিদ্দিকী, তার দলবল নিয়ে কিছু হাতপা বাধা রাজকারকে বেয়োনেট
দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছিল। আন্তর্জাতিক আইনে কোন বন্দীকে হত্যা
করা গুরুতর যুদ্ধাপরাধ। আর সেটি ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রকাশ্যে,ঢাকা
স্টেডিয়াম হাজার হাজার মানুষের সামনে। কিন্তু যে ব্যক্তিটি এ নৃশংস
যুদ্ধাপরাধের সাথে জড়িত তাকে জাতীয় বীর হিসাবে মুজিব সরকার স্বীকৃতি দেয়।
হত্যারত কাদের সিদ্দিকীর ছবি বিদেশী পত্রিকায় ছাপাও হয়েছিল। ভারতীয় বাহিনী
তাকে গ্রেফতারও করে, কিন্তু মুজিব তাকে ছাড়িয়ে নেন।)
আমার স্মরণ
হলো,১৮ই ডিসেম্বর যখন আমি ঢাকায় ছিলাম,তখন লোকজন বলছিল,“মুজিব থাকলে সেই
নির্মম,ভয়ংকর ঘটনা কখনোই ঘটতো না”। কিন্তু গতকাল (মুজিবের বাংলাদেশে ফিরে
আসার পর) মুক্তিবাহিনী কেন আরো ৫০ জন নিরীহ বিহারীকে হত্যা করেছে?.. আমি
বিস্মিত হয়েছি যে,এই ব্যক্তিটি ১৯৬৯ সালের নভেম্বরে সাংবাদিক অ্যালডো
শানতিনিকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন আমার দেশে আমি সবচেয়ে সাহসী এবং নির্ভীক
মানুষ,আমি বাংলার বাঘ,দিকপাল।.. এখানে যুক্তির স্থান নেই।.. আমি বুঝতে
পারিনি আমার কি ভাবা উচিত।
সোমবার সন্ধাঃ ..তার মানসিক যোগ্যতা
সম্পর্কে আমার সন্দেহ ছিল।..তার ভারসাম্যহীনতাকে আমি আর কোন ভাবেই ব্যাখা
করতে পারি না।..আমি যত তাকে পর্যবেক্ষণ করেছি,তত মনে হয়েছে তিনি কিছু একটা
লুকাচ্ছেন। এমন কি তার মধ্যে যে সার্বক্ষণিক আক্রমণাত্মক ভাব, সেটাকে আমার
মনে হয়েছে আত্মরক্ষার কৌশল বলে। ঠিক চারটায় আমি সেখানে ছিলাম। ভাইস
সেক্রেটারি আমাকে করিডোরে বসতে বললেন,যেখানে কমপক্ষে পঞ্চাশজন লোকে
ঠাসাঠাসি ছিল। তিনি অফিসে প্রবেশ করে মুজিবকে আমার উপস্থিতি সম্পর্কে
জানালেন। আমি একটা ভয়ংকর গর্জন শুনলাম এবং নিরীহ লোকটি কম্পিতভাবে পুনরায়
আবির্ভূত হয়ে আমাকে প্রতীক্ষা করতে বললেন। আমি প্রতীক্ষা করলাম-এক
ঘণ্টা,দুই ঘণ্টা,তিন ঘণ্টা,চার ঘণ্টা –রাত আটটা যখন বাজলো তখনো আমি সেই
অফিসের করিডোরে অপেক্ষামান। রাত সাড়ে আটটায় আমাকে প্রবেশ করতে বলা হলো। আমি
বিশাল এক কক্ষে প্রবেশ করলাম। একটি সোফা ও দুটো চেয়ার সে কক্ষে।
মুজিব সোফার পুরোটায় নিজেকে বিস্তার করেছেন এবং দুইজন মোটা মন্ত্রী চেয়ার
দু’টো দখল করে বসে আছেন। কেউ দাঁড়ালো না। কেঊই আমাকে অভ্যার্থনা জানালো
না।কেউ আমার উপস্থিতিকে গ্রাহ্যও করলো না। মুজিব আমাকে বসতে বলার সৌজন্য
প্রদর্শন না করা পর্যন্ত সুদীর্ঘক্ষণ নীরবতা বিরাজ করছিল।আমি সোফার ক্ষুদ্র
প্রান্তে বসে টেপ রেকর্ডার খুলে প্রথম প্রশ্ন করার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
কিন্তু আমার সে সময়ও ছিল না।
মুজিব চিৎকার শুরু করে দিলেন,
“হ্যারি আপ,কুইক, আন্ডারষ্টান্ড? ওয়েষ্ট করার মত সময় আমার নাই। ইজ দ্যাট
ক্লিয়ার?..পাকিস্তানীরা ত্রিশ লক্ষ লোক হত্যা করেছে, ইজ দ্যাট ক্লিয়ার?
আমি বললাম,মি. প্রাইম মিনিস্টার..। “মি. প্রাইম মিনিস্টার, গ্রেফতারের সময় কি আপনার উপর নির্যাতন করা হয়েছিল?”
“ম্যাডাম নো। তারা জানতো,ওতে কিছু হবে না। তারা আমার বৈশিষ্ট্য,আমার
শক্তি,আমার সম্মান,আমার মূল্য,বীরত্ব সম্পর্কে জানতো,আন্ডারস্ট্যান্ড?”
“তা বুঝলাম। কিন্তু আপনি কি করে বুঝলেন যে তারা আপনাকে ফাঁসীতে ঝুলাবে? ফাঁসীতে ঝুঁলিয়ে কি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়?”
“নো নো ডেথ সেন্টেন্স?” এই পর্যায়ে তাকে দ্বিধাগ্রস্ত মনে হলো। এবং তিনি গল্প শুরু করলেন,
“আমি এটা জানতাম। কারণ ১৫ই ডিসেম্বর ওরা আমাকে কবর দেয়ার জন্য একটা গর্ত খনন করে”।
“কোথায় খনন করা হয়েছিল সেটা?”
“আমার সেলের ভিতর।”
“আপনার প্রতি কেমন আচরণ করা হয়েছে মি. প্রাইম মিনিস্টার?”
“আমাকে একটি নির্জন প্রকোষ্ঠে রাখা হয়েছিল। এমনকি আমাকে সাক্ষাৎকারের
অনুমতি দেয়া হতো না। সংবাদপত্র পাঠ করতে বা চিঠিপত্রও দেয়া হতো না,
আন্ডারস্ট্যান্ড?”
“তাহলে আপনি কি করেছেন?”
“আমি অনেক চিন্তা করেছি।”
“আপনি কি পড়েছেন?”
“বই ও অন্যান্য জিনিস।”
“তাহলে আপনি কিছু পড়েছেন।”
“হ্যা কিছু পড়েছি।”
“কিন্তু আমার ধারণা হয়েছিল,আপনাকে কিছুই পড়তে দেয়া হয়নি। “
“ইউ মিস আন্ডারস্টুড।”
“..কি হলো যে শেষ পর্যন্ত ওরা আপনাকে ফাঁসীতে ঝুলানো না।”
“জেলার আমাকে সেল থেকে পলাতে সহায়তা করেছেন এবং তার বাড়ীতে আশ্রয় দিয়েছেন।”
“কেন,তিনি কি কোন নির্দেশ পেয়েছিলেন?
“আমি জানি না। এ ব্যাপারে তার সাথে আমি কোন কথা বলিনি এবং তিনিও আমার সাথে কথা কিছু বলেননি।”
“নীরবতা সত্ত্বেও কি আপনারা বন্ধুতে পরিণত হয়েছিলেন।”
“হ্যাঁ,আমাদের মধ্যে বহু আলোচনা হয়েছে এবং তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, আমাকে সাহায্য করতে চান।”
“তাহলে আপনি তার সাথে কথা বলেছেন।”
“হ্যাঁ,আমি তার সাথে কথা বলেছি।”
“আমি ভেবেছিলাম,আপনি কারোই সাথে কথা বলেননি।”
“ইউ মিস আন্ডারস্টুড।”
... এরপর ১৮ই ডিসেম্বর হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি রাগে ফেটে পড়েন। নিচের অংশটি আমার টেপ থেকে নেয়া।
“ম্যাসাকার? হোয়াট ম্যাসাকার?”
“ঢাকা স্টেডিয়ামে মুক্তিবাহিনীর দ্বারা সংঘটিত ঘটনাটি?”
“ঢাকা স্টেডিয়ামে কোন ম্যাসাকার হয়নি। তুমি মিথ্যে বলছো।”
“মি. প্রাইম মিনিস্টার,আমি মিথ্যাবাদী নই। সেখানে আরো সাংবাদিক ও পনের
হাজার লোকের সাথে আমি হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছি। আমি চাইলে আমি আপনাকে
তার ছবিও দেখাবো। আমার পত্রিকায় সে ছবি প্রকাশিত হয়েছে।”
“মিথ্যাবাদী, ওরা মুক্তিবাহিনী নয়।”
“মি. প্রাইম মিনিস্টার,দয়া করে মিথ্যাবাদী শব্দটি আর উচ্চারণ করবেন না।
তারা মুক্তিবাহিনী। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিল আব্দুল কাদের সিদ্দিকী এবং তারা
ইউনিফর্ম পরা ছিল।”
“তাহলে হয়তো ওরা রাজাকার ছিল যারা প্রতিরোধের বিরোধীতা করেছিল এবং কাদের সিদ্দিকী তাদের নির্মূল করতে বাধ্য হয়েছে।”
“মি. প্রাইম মিনিস্টার,..কেউই প্রতিরোধের বিরোধীতা করেনি। তারা ভীতসন্ত্রস্ত ছিল। হাত পা বাঁধা থাকায় তারা নড়াচড়াও করতে পারছিল না।”
“মিথ্যেবাদী।”
“শেষ বারের মতো বলছি, আমাকে মিথ্যেবাদী বলার অনুমতি আপনাকে দেবো না।”
(ইন্টারভিউ উইথ হিস্টরী,ওরিয়ানী ফালাসী অনুবাদে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু,ইত্তেফাক )।
এই হলো মুজিবের চরিত্র ও মানবতার মান। ঢাকা স্টেডিয়ামে হাতপা বাঁধা
রাজাকারদের কাদের সিদ্দীকী ও তার সাথীরা হত্যা করল,বিদেশী পত্রিকায় সে খবর
ছাপা হলো,বহু সাংবাদিকসহ বহু হাজার বাংলাদেশী সেটি দেখল,অথচ শেখ মুজিব সেটি
বিশ্বাসই করতে চান না। এতবড় যুদ্ধাপরাধের ন্যায় সত্য ঘটনাকে তিনি মিথ্যা
বলছেন। অপর দিকে যে পাকিস্তান সরকার তার গায়ে একটি আঁচড়ও না দিয়ে জেল থেকে
ছেড়ে দিল তাদের বিরুদ্ধে বলছেন,তাকে নাকি তারা হত্যা ও হত্যা শেষে দাফন
করার জন্য তাঁরই জেলের প্রকোষ্টে একটি কবর খোদাই করেছিল! অথচ তার কোন
প্রমাণই নেই। কিন্তু সমস্যা হলো,সাধারণ বাংলাদেশীদের জন্য ইতিহাসের এ সত্য
বিষয়গুলো জানার কোন পথই খোলা রাখা হয়নি। ইতিহাসের বই থেকে এসব সত্যগুলোকে
পরিকল্পিত ভাবে লুকানো হয়েছে। নতুন প্রজন্মকে এ বিষয়ে কিছুই জানতে দেয়া
হচ্ছে না।
collected